স্বদেশ ডেস্ক:
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আজ থেকে সারাদেশে সাত দিনের লকডাউন। গত শনিবার দুপুরে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিতেই বিকাল থেকেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন সাধারণ মানুষ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে অবশ্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গতকাল। এর পর নামে গ্রামমুখী লোকজনের স্রোত। দৃশ্য দেখে মনে হয়, এ যেন ঈদযাত্রা। নগরীর বাস কাউন্টারগুলোতে টিকিট বিক্রির ধুম। ভিড় নামে লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশনেও। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাস, লঞ্চ, ট্রেনে ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই।
ঢাকার সদরঘাটে গতকাল ছিল ভয়াবহ ভিড়। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে পরিবার পরিজন নিয়ে তারা ছুটে যান গ্রামের বাড়িতে। লঞ্চের জন্য টার্মিনালের পন্টুনে গাদাগাদি করে অপেক্ষা করতে দেখা যায় যাত্রীদের। এতটাই ভিড় ছিল যে, স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এ যাত্রা। অথচ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার আজ থেকে সাত দিনের জন্য জরুরি সেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করেছে। গেল বছরও করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এমন দৃশ্য দেখা যায়।
স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী, ডেক ও সিটে ৫০ শতাংশ যাত্রী ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও ঘরমুখো মানুষের স্রোতে কে শোনে কার কথা? ভিড়ে যাত্রীর চাপ সামলানোই ছিল কর্তৃপক্ষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দলে দলে মানুষ কাঁধে ব্যাগ ও কোলে শিশুসন্তান নিয়ে লঞ্চের জন্য সদরঘাটে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা জানান, সদরঘাট থেকে সকালেই চাঁদপুর, ভোলা, সুরেশ্বর, নড়িয়া, মুলফৎগঞ্জ, চ-িপুর, নোমরহাট, গঙ্গাপুর, দুলারচর, মুন্সীগঞ্জ, মোহনপুরসহ বিভিন্ন জায়গার লঞ্চ ছেড়ে যায়।
বিকাল থেকে ছেড়ে যায় বরিশাল অঞ্চল, মাদারীপুর, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার লঞ্চ। ফলে সকাল থেকেই সদরঘাট এলাকায় তৈরি হয় তীব্র যানজট। তবে লঞ্চে প্রবেশের শুরুতে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার ও মাস্ক পরার জন্য বারবার সচেতন করা হলেও ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অনেকেই। করোনাকালে যাত্রী বহনের বিধিনিষেধ মানছে না বেশিরভাগ লঞ্চ কর্তৃপক্ষও।
যদিও ঘাটে ও লঞ্চে মাইকিং করে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সচেতন করা হয়। গ্রিনলাইন ওয়াটার ওয়েজের টিকিট কাউন্টার থেকে আকরামুল নামে একজন বলেন, ‘যাত্রীর চাপ অন্য দিনের চেয়ে বেশি। তবে আমরা অর্ধেক যাত্রী নিয়েই চলছি।’ ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আকরামুল বলেন, ‘আগের ভাড়ার সঙ্গে ১০০ টাকা যোগ করেছি কেবল। আগে ৭০০ টাকা ভাড়া ছিল এখন ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।’
একই অবস্থা দেখা যায়, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়। মানুষের উপচেপরা ভিড়ে আশপাশের সড়কগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অনেককে হেঁটে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছেন। অনেকে আবার বাস ও ট্রেনের সিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। না পেয়ে অনেকেই আবার বিকল্প পথে রওনা দেন বাড়ির উদ্দেশে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আলামিন সুজন লকডাউন ঘোষণায় সকাল ৯টায় মিরপুরের বাসা থেকে কুমিল্লায় বাড়ির উদ্দেশে বের হন। দীর্ঘসময় জ্যামে আটকে থেকে শাহবাগ এসে বাস থেকে নেমে মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। সুজন বলেন, ‘প্রায় দেড় ঘণ্টায় শাহবাগ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। এর পর ৪০ মিনিট পার, গাড়ি যেখানে ছিল সেখানেই। তাই বিকল্প পথে মোটরসাইকেল নিয়ে সায়েদাবাদ রওনা হই।’
গতকাল ভোর থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনে বাড়তে থাকে যাত্রীর চাপ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকিট বিক্রি করার কারণে অনেকেই ফেরত যান স্টেশন থেকে। এর পরও স্টেশনের প্রবেশমুখেই ছিল টিকিট সংগ্রহকারীদের ভিড়। বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হায়দার নামে এক যাত্রী জানান, তিনি যাবেন পাবনার বড়াল ব্রিজে। একটি কাজের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু লকডাউনের ঘোষণা আসায় কাজ শেষ না করেই পাবনায় ফিরছেন। কারণ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে কাজটাও হবে না, আবার বাড়িও ফিরতে পারবেন না।
টিকিটপ্রত্যাশী আরেক যাত্রী নাজমুল যাবেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আমি চাকরি করি। সোমবার থেকে লকডাউন হওয়া আমার অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং আমার ঢাকায় থেকে কোনো লাভ নেই। সে জন্যই বাড়ি যাচ্ছি।’ লাইনে থাকা যাত্রী আবদুল লতিফ বলেন, ‘ঢাকায় দিনমজুরি করি। লকডাউন হইলে কোনো কাম থাকব না। আর কাম না থাকলে ঢাকায় না খাইয়া মরণ লাগব। হের চেয়ে ভালো গেরামে ফিইরা যাওয়া।’
কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার অবশ্য বলেন, ‘লকডাউনের ঘোষণায় স্টেশনে যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। তবে আমরা সরকারের নির্দেশনা মেনে, অর্ধেক আসনে টিকিট বিক্রি করছি। কোনোভাবেই আমরা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করব না।’ তিনি বলেন, ‘সোমবার থেকে সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে জন্য ৫ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিক্রীত সব টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে।’
ট্রেনের মতো গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর শ্যামলী, কল্যাণপুর ও গাবতলীর বাস কাউন্টারগুলোতে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ লক্ষ করা গেছে। দিনের শেষভাগে টার্মিনালগুলোতে মানুষের চাপ ছিল অস্বাভাবিক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের বাধ্যবাধকতার জেরে প্রায় সব টিকিটের দাম দ্বিগুণের চেয়েও বেশি ছিল। কিছু বাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক টিকিট বিক্রি করলেও বেশিরভাগই দ্বিগুণ দামেই বিক্রি হয় প্রতি সিটের টিকিট। মহাখালী বাস টার্মিনালে বেশ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারের নির্ধারিত ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়লেও অর্ধেকের বেশি ভাড়া নেওয়া হয় বাস কাউন্টারে।
ঢাকা থেকে জামালপুর পর্যন্ত দুই সিটে একজন হিসাবে সাড়ে ৫০০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। আগের হিসাবে জামালপুর পর্যন্ত যেতে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা নেওয়া হতো। উত্তর বঙ্গের ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও দিনাজপুর রুটে চলাচলরত হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে কর্মরত সৈকত বলেন, ‘লকডাউনের খবরে গতকাল (শনিবার) থেকেই আজকের (রবিবার) টিকিটের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। আজ সকাল থেকে অনেকেই টিকিট কিনতে এসে কাক্সিক্ষত সময়ের বাস পাননি। রাত পর্যন্ত এ পরিবহনের বেশিরভাগ টিকিটই ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।’
গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে যান বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর হোসেন মজুমদার, উপপরিচালক শফিকুজ্জামান ভুইয়াসহ সংস্থার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তারাও সেখানে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ অনুভব করেন। রাজশাহী যেতে দেশ ট্রাভেলসের টিকিট কিনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সেতু। তিনি বলেন, ‘গতবছর থেকে করোনার কারণে দীর্ঘদিন বাড়িতে ছিলাম। এবার প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ও খোলার কথা শোনা যাচ্ছিল।
কিন্তু আবার লকডাউন দিয়েছে তাই ঢাকায় থাকার মানে হয় না।’ পরিবার-পরিজনকে বাসে তুলে দিতে এসেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সামনে রমজান-ঈদ আসছে। লকডাউন দেওয়ায় সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার যেহেতু এখনো ছুটির বিষয়টি নিশ্চিত নই, তাই আমি থেকে যাচ্ছি।’